প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভের পূর্বে ৬ বছরের কম বয়সের শিশুদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা। ৩ থেকে ৫/৬ বছর বয়সী শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী তাদের যত্ন, বেড়ে উঠা এবং শিশু অধিকার নিশ্চিত করা, খেলাধুলা, আনন্দ, অক্ষরজ্ঞান এবং গণনার হাতেখড়ির মাধ্যমে তাদের উন্নয়ন এবং শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার সময় এটি।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে সাধারণত দুটি ধাপে বিভক্ত করা হয় ৩-৫ বছরের শিশুদের জন্য নার্সারি/প্লে গ্রুপ বা প্রাক-কিন্ডার গার্টেন এবং ৫-৬ বছরের শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক বা কিন্ডারগার্টেন। অবশ্য, কোন কোন স্কুলে ৩-৪ বছরের শিশুদের জন্য প্লে-গ্রুপ, ৪-৫ বছরের শিশুদের জন্য নার্সারি, ৫-৬ বছরের শিশুদের জন্য কেজি-১ এবং ৬-৭ বছরের শিশুদের জন্য কেজি-২ শ্রেণীতে শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
স্কুল এবং প্রতিদিনকার জীবন-যাপনে সফলতা আনার জন্য শিশুকাল থেকেই দক্ষতা, জ্ঞান এবং আচরণ শেখানোর জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা। এটি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগী এবং সকল ধরনের উন্নয়নের জন্য কাজ করে। এর কয়েকটি লক্ষ্য হলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি ঝোঁক তৈরির জন্য শিশুদের মানসিক এবং শারীরিকভাবে প্রস্ত্তত করানো, শিশুদের উপযোগী খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর সামাজিকীকরণ শিক্ষা, শিশুদের গান, নাচ, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন. গল্প বলা, গণনা এবং বর্ণমালা শিক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস তৈরি করা।
স্বাধীনতার পর থেকে, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব এবং ছোট শিশুদের উপযুক্ত যত্ন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ দিবাযত্নকেন্দ্র এবং নার্সারি স্কুলের আদলে ছোট শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুদরাত-ই-খুদা (১৯৭৪) এবং মফিজউদ্দিন আহমেদ (১৯৮৮)-এর নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশন শিশুদের শিক্ষার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং দেশে এর প্রচলনের জোর সুপারিশ করেছে। এই শিক্ষা কমিশন শহর ও শিল্প এলাকায়, বিশেষত যাদের অভিভাবকগণ বাইরে কাজ করেন, সে সকল শিশুদের জন্য নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। মফিজউদ্দিন কমিশন যেখানে বেসরকারি উদ্যোগ নেই এরূপ সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুশ্রেণী খোলার সুপারিশ করেছে। ১৯৯৫ সালে গঠিত সবার জন্য শিক্ষা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ‘সবার জন্য শিক্ষা’ লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ছোট শিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সুপারিশ পেশ করে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১৯৯৭ সালে গঠিত কমিটিও সুপারিশ করে যে, ১ম শ্রেণির প্রথম ছয়মাস প্রস্ত্ততিমূলক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করা যায়। কমিটি শিশুদের শিক্ষা দানের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলা শিক্ষকদের নিয়োগ করারও পরামর্শ দেয়।
সকল শিক্ষা কমিশনই প্রতিটি ছোট শিশুকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের সুপারিশ করলেও আজ অবধি সে লক্ষ্যে তেমন কিছু করা হয় নি। অবশ্য, বাংলাদেশ সরকার স্বীকার করেছে যে, পাঁচ বছর বয়সের ঊর্ধ্বের শিশুদের জন্য একটি পৃথক প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থাকা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে শিশুশ্রেণি খোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে এ কাজটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংগঠন/প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নার্সারি বিদ্যালয়সমূহের মাধ্যমে করা হচ্ছে। শুরুতে চাহিদা পূরণের জন্য বেসরকারিভাবে কয়েক হাজার প্রিস্কুল চালু করা হয়, কিন্তু এগুলি চাহিদানুযায়ী যথেষ্ট নয়। তাই, শিশুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে অভিভাবক ও বড়দের কাছ থেকেই তাদের শিশুকালীন শিক্ষা লাভ করে থাকে। যে সকল শিশুর অভিভাবক ও অন্যান্য সদস্য শিক্ষিত নয়, তারা থেকে যায় অবহেলিত। তবে পাঁচ বছরের উপরের বেশিরভাগ শিশুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে প্রাক-প্রাথমিক ক্লাসে যোগদান করে আসছে।
দেশে কতগুলি নার্সারি বিদ্যালয় আছে, তা বলা কঠিন। কতিপয় তথ্য অনুযায়ী, কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা ২,৫০০, কিন্ডারগার্টেন সমিতি এ সংখ্যাকে প্রায় ৫,০০০ বলে থাকে। এগুলির অধিকাংশই শহর এলাকায় অবস্থিত। সাধারণত বিশেষ কোন সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই এ সকল স্কুল কিন্ডারগার্টেন এবং প্রাথমিক উভয় ধরনের শিক্ষার জন্যই চালু করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এগুলি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কলেজে রূপান্তরিত হয়। কিছু কিছু এনজিও বিশেষত দরিদ্রদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে কাজ করছে। এগুলি সাধারণত বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করে থাকে। প্রায় ৩৮,০০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সমসংখ্যক বেসরকারি স্কুলে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। যথাযথ প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও সহায়ক সামগ্রী ব্যতিরেকেই এ সকল ক্লাস পরিচালিত হয়। অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রাক-প্রাথমিক স্কুলে ভৌত সুবিধাদি অত্যন্ত অপ্রতুল।
এলাকা ও স্কুলের পরিসম্পদ ভেদে স্কুলের বেতনের তারতম্য ঘটে থাকে। থানা বা ইউনিট পর্যায়ে স্কুলের বেতন খুবই কম। সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলিতে সাধারণত বিনা বেতনে পড়ানো হয়। এনজিও কর্তৃক পরিচালিত কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে বিনামূল্যে পড়ায় অথবা নামমাত্র বেতন নেওয়া হয়। ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রবেতন অতি উচ্চ। উপরন্তু, প্রতি শিক্ষাবর্ষের প্রারম্ভে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এককালীন মোটা অঙ্কের ফিস বা উন্নয়ন চার্জ নেওয়া হয়। বেসরকারি স্কুলগুলিতে এত বিপুল পরিমাণ ফিসগ্রহণ রোধকল্পে কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠান নেই।
বাংলাদেশে জন্ম নিবন্ধীকরণ সফলভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে কিন্ডারগার্টেনে অধ্যয়নের উপযুক্ত শিশুর সঠিক সংখ্যা নিরূপণও সম্ভব নয়। তথাপি, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ১৯৯৫ সালে প্রদত্ত সম্ভাব্য জনসংখ্যার পূর্বানুমান থেকে প্রাক্কলন করা হয়েছে যে, দেশে প্রাক-প্রাথমিক (৩-৫ বছর) শ্রেণিভুক্ত ৯.১২ মিলিয়ন শিশু রয়েছে।
দেশব্যাপী কোন জরিপ পরিচালিত না হওয়ায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা গ্রহণকারী শিশুদের প্রকৃত সংখ্যা জানাও কঠিন। ৩৮,০০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গড়ে ৫০ জন শিক্ষার্থী ধরে নিলে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১.৯ মিলিয়ন। যদি দেশে প্রায় ৫,০০০ কিন্ডারগার্টেন স্কুল থাকে এবং প্রাক-প্রাথমিক ১ম শ্রেণিতে গড়ে ৫০ জন শিক্ষার্থী থাকে, তবে এ সকল স্কুলে প্রায় ০.২৫ মিলিয়ন শিক্ষার্থী থাকবে। ঐ দুটো সংখ্যা মিলিয়ে হিসাব দাঁড়ায় ২.১৫ মিলিয়ন। এটা ঐ বয়স গ্রুপের মোট জনসংখ্যার ২৪%। অবশ্য একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী এনজিওদের স্কুলেও যোগ দিয়ে থাকে।
কিন্ডারগার্টেন স্কুলসমূহের জন্য কোন একক বা সাধারণ পাঠ্যক্রম নেই। সম্প্রতি (১৯৯৮) জাতীয় পাঠ্যক্রম বোর্ড (এনসিটিবি) প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীর জন্য একটি পাঠ্যপুস্তক (যার নাম দেখাশুনা) প্রণয়ন করেছে। সকল স্কুলে বেসরকারিভাবে প্রচলিত সকল কিন্ডারগার্টেন নিজস্ব কিছু শিক্ষার দিক নির্দেশনা (পাঠ্যক্রম পাঠ্যসূচি) অনুসরণ করে থাকে। ১৯৯৮ সালে কারিতাস এডুকেশনাল প্রোগ্রামের সহযোগিতায় ঢাকায় ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ডহুড এডুকেশন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কে.জি স্কুলসমূহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রণয়নসহ বিষয়বস্ত্ত চিহ্নিত করে এবং শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করে।
বর্তমানে দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কোন দিক-নির্দেশনামূলক নীতিমালা নেই। অধিকাংশ স্কুলে শিশুদের আনুষ্ঠানিক ১ম ও ২য় শ্রেণির মতো আনুষ্ঠানিক পড়া, লেখা, গণনা, যোগ, বিয়োগ শিক্ষা দেওয়া হয়। অধিকন্তু, শিশুদের সাফল্যের পর্যায় পরিমাপের জন্য নিয়মিত পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। কিছু স্কুলে শিক্ষার মাধ্যম হচ্ছে ইংরেজি। কোন কোন স্কুলে শিশুদের বাংলা, ইংরেজি, ভাষা, পরিবেশ, গণিত-এর পুস্তকাদি পড়তে এবং দশ পর্যন্ত নামতা ইত্যাদি মুখস্থ করতে বলা হয়। কিছু স্কুলে ছোট শিশুদের আরবি অক্ষর পড়তে ও লিখতে শিখানো হয়।
যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৫০ হয়, তবে এ পর্যায়ে শিশুদের পরিচালনাকারীর আনুমানিক সংখ্যা হচ্ছে ৪৮,০০০। তাদের অধিকাংশই ছোট শিশুদের পাঠদানে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত নয়। কিভাবে পড়াতে হয়, এটা না জেনেই সাধারণত পাঠ দান করে থাকে। প্রাকস্নাতক, স্নাতক এবং কখনও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ব্যক্তিগণকে এ সকল শিশুদের শিক্ষা দানে নিয়োগ করা হয়। এদের অধিকাংশই মহিলা।
২০০০ সালের শিক্ষা নীতিতে বিশেষ কিছু স্কুলে ১ বছর ব্যাপী প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হলেও এখন প্রায় সকল স্কুলে করা হচ্ছে। এর বিকল্প হিসেবে ভাবা হয়েছিল যে ক্লাস ওয়ানের আগে ৬ মাস প্রিপেটরি শিক্ষা এবং ২০০৫ সাল নাগাদ এটিকে ১ বছর মেয়াদি করা হবে বলে সেই সময় বলা হয়েছিলো। এর পরে বলা হয়েছিলো যে এই প্রিপ্রাইমারিতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য এলাকার লোকেরাই এটির ব্যয়ভার বহন করবে।
জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩ এ বলা হয়েছে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি ৫ বছর বয়সী সকল শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবেন এবং প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাবেন। এই উদ্দেশ্যে সরকারিভাবে প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছয়টি করে নতুন শ্রেণীকক্ষ তৈরি এবং বাড়তি ছয়জন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯ এ ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ২ বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়। যদিও সকল শিক্ষা কমিশন, নীতি এবং কমিটি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলেছেন কিন্তু এখনও পর্যন্ত এটি পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয় নি। বেসরকারিভাবে নার্সারি স্কুলগুলি এটি করছে যদিও তা পর্যাপ্ত নয়। [কামরুন্নেসা বেগম এবং সারা সুলতানা]